Walton
ads
D Diamond

সাজছে সাগরকন্যা, পর্যটকদের জন্য বাড়ছে সুবিধা

পটুয়াখালী প্রতিনিধি

মঙ্গলবার, ২৮ জুন ২০২২, রাত ৯:২৩

sagorkonna.jpg

পায়রা নদীর ওপর লেবুখালী সেতু নির্মাণের পরেই বলা হয়েছিল সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পৌঁছাতে সময় কম লাগবে। তখন বলা হয় মাত্র সাত ঘণ্টায় পৌঁছা যাবে। তবে এবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে সময় আরও কমে এসেছে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সড়ক পথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় কক্সবাজার থেকেও দ্রুত পৌঁছা যাবে ১৮ কিলোমিটার বিস্তৃত এ সৈকতে।

কুয়াকাটায় দাঁড়িয়ে একইসঙ্গে দেখা মিলবে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের। লাল কাঁকড়ার সঙ্গে অবিরাম ছোটাছুটি, বালুকা বেলায় প্রিয়জনের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি, দিগন্ত জোড়া আকাশ আর সমুদ্রের নীল জলের তরঙ্গায়িত ঢেউ ও উড়ে যাওয়া সাদা গাংচিলের দল দেখা এখন আরও সহজ হবে। এক পাশের বিশাল সমুদ্র আর অন্য পাশের নারিকেল গাছের সারি, পরিচ্ছন্ন বেলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভ বন সাগরকন্যাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

এদিকে পদ্মা সেতুর সুফল পেতে কুয়াকাটার পর্যটন সংশ্লিষ্টরা কোমর বেঁধে নেমেছেন। নতুন নতুন স্থাপনা তৈরির পাশাপাশি পর্যটক আকর্ষণে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। বলা চলে নতুনসাজে নিজেকে মেলে ধরতে প্রস্তুত সাগরকন্যা।

ইতোমধ্যে সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে কুয়াকাটার বিভিন্ন হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের ভাড়ায় ৫০ শতাংশ ছাড় চলছে।

কুয়াকাটার হোটেলে-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও হোটেল বনানীর মালিক শফিকুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে কুয়াকাটার হোটেল-মোটেলে পর্যটক আকর্ষণে ৫০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেতু দিয়ে চলার আনন্দ ভাগাভাগি করতে এ বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, পর্যটকদের কুয়াকাটা ভ্রমণ আরও আনন্দদায়ক করতেই আমাদের এ বিশেষ উদ্যোগ।

দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় বছরজুড়ে থাকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আনাগোনা। তবে বিগত দিনে কুয়াকাটায় আসতে পর্যটকদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কুয়াকাটা হোটেলে-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের মালিক মোতালেব শরীফ বলেন, আগে ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগতো। এ দীর্ঘ ভ্রমণে পর্যটকরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর মাত্র ছয় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় পৌঁছাবে বাসগুলো। এতে পর্যটকদের সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ক্লান্তিও কমবে।

এদিকে পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের যে চাপ বাড়বে তা সামাল দিতে এবং সেবার মান বাড়ানো নিয়ে কাজ করছেন হোটেল ও মোটেল মালিকরা।

মোতালেব শরীফ বলেন, পদ্মা সেতুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কুয়াকাটার হোটেল মালিকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন ছোট-বড় ১৫০টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ১৫ হাজার পর্যটক আরামে থাকতে পারেন। পদ্মা সেতু চালুর পর এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। পর্যটকের বাড়তি চাপ সামাল দিতে কয়েকটি হোটেল তাদের অবকাঠামো ও সেবার মান বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার পর্যটক কুয়াকাটায় অবস্থান করেন। পর্যটন মৌসুমে এ সংখ্যা তিন থেকে চারগুণ বাড়ে।

বাড়তি পর্যটকের চাপ সামাল দিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন বিভিন্ন হোটেল-মোটেলের মালিকরা। অতিথিদের উন্নত সেবা নিশ্চিতে চলছে পুরনো হোটেল সংস্কারের পাশাপাশি নতুন হোটেল নির্মাণের কাজ। হোটেলের কক্ষ, জনবল ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

কুয়াকাটার অন্যতম সিকদার রিসোর্টের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. আল আমিন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটায় পর্যটকের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। সে অনুযায়ী আমরাও হোটেলে সেবার মান বৃদ্ধিসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন শুরু করেছি। আমাদের এখানে আগে ১২টি ভিলা ও ৬৮টি রুম ছিল। বর্তমানে আরও ২০টি ভিলা ও আরও ৩৪টি রুম তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ১৩-তলা বিশিষ্ট সিকদার টাওয়ার থেকে সরাসরি সমুদ্র, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগের সুবিধা রয়েছে।

ঢাকা থেকে আগত পর্যটক রিয়াজুল ইসলাম জানান, কুয়াকাটা ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলেও এতদিন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল মূল প্রতিবন্ধকতা। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে সেই প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের চেয়ে সড়ক পথে কুয়াকাটায় যেতে সময় কম লাগবে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুয়াকাটা সৈকতে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। স্পিডবোট ও বোট সার্ভিসে ঘুরে বেড়াতে পারবেন অতিথিরা। সৈকত থেকে ট্যুরিস্ট বোটে করে যেতে পারেন প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ফাতরার বনে। এটি সুন্দরবণের একটি অংশ। এখানে নানা জাতের গাছপালা ছাড়াও রয়েছে হরিণ, কুমিরসহ নানা জাতের বন্যপ্রাণী। সব মিলে পর্যটকরা এখানে পেয়ে যাচ্ছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ফুল প্যাকেজ।

১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে হাঁটা, সাগরে গোসল করা, গঙ্গামতিসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নানা ধরনের পাখপাখালির উপস্থিতি উপভোগ, কুয়াকাটায় সংরক্ষিত রাখাইনদের প্রাচীন কাঠের নৌকা, ঐতিহ্যবাহী ‘মাথিনের কুয়া’, রাখাইন পল্লি ও রাখাইন মন্দির পরিদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন পর্যটকরা। এছাড়া পর্যটকরা কুয়াকাটা সৈকত থেকে পাঁচ কিলোমিটার আগের মিস্ত্রিপাড়ার এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম রাখাইন মূর্তিসহ নান্দনিক ডিজাইনের মন্দির দেখতে পারবেন।

এসব স্পট ঘুরিয়ে দেখাতে ও পর্যটকদের উন্নত সেবা দিতে ট্যুর গাইডদেরও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম বাচ্চু বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পর্যটক কুয়াকাটায় আসবেন। সেজন্য ট্যুর গাইডদের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি সৈকতকে আরও সুন্দর করারও চেষ্টা চলছে। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে কুয়াকাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সে বিষয়েও আমরা কর্মীদের উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষিত করছি।

কুয়াকাটার সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম মিরন বলেন, আমরা এখন নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটক পাই। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে হোটেল রুম, জনবল, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

এছাড়া পর্যটকদের জন্য হোটেল-মোটেলের পাশাপাশি হোম স্টের সুযোগ বাড়াতে কাজ চলছে।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় পর্যটক আরও বাড়বে। বাড়তি পর্যটকের চাপ সামলানোর জন্য আমরা আশপাশের বাসাবাড়িতেও ‘হোমস্টে’ সার্ভিস চালু করছি। ইতোমধ্যে বাসাবাড়ির প্রায় ৫০০ মালিককে আমরা পর্যটকদের সেবা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও দিয়েছি। এটি আরও বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।

ট্যুরিস্ট নৌকা ‘জল তরণী’র মালিক আরিফুর রহমান বলেন, কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি ফাতরার বন ও হরিণঘাটার সংরক্ষিত বনও গুরে দেখতে পারবেন। সেখানে যেতে আমরা ট্যুরিস্ট বোট সার্ভিস দিয়ে থাকি। এর ব্যয়ভারও সাধ্যের মধ্যে। কেউ পুরো নৌকা ভাড়া নিতে পারেন অথবা শীতকালের পর্যটন মৌসুমে আমাদের নিয়মিত ট্রিপেও অন্যদের সঙ্গে সঙ্গী হতে পারেন।