Walton
ads
D Diamond

লি সিয়া: চীনের সপ্তম সৌরপদ

বিশ্বকণ্ঠ ডেস্ক

রবিবার, ৫ জুন ২০২২, রাত ৯:৩৭

Top-02.jpg

বাংলাদেশে বছরে ঋতুর সংখ্যা ৬টি, কিন্তু চীনে ৪টি। চীনে বছর শুরু হয় অধিকাংশ চীনার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বসন্ত দিয়ে। তারপর একে একে আসে গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। বাংলাদেশে সাধারণভাবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ঋতু হচ্ছে বর্ষা। চীনে বৃষ্টিপাত হয় প্রতি বছরই, কিন্তু ‘বর্ষা’ নামে আলাদা কোনো ঋতু নেই!

অন্যদিকে চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে চারটি ঋতুর ব্যাপ্তিকাল সমান। তবে উত্তর চীনে শীতকাল এবং দক্ষিণ চীনে গ্রীষ্মকাল তুলনামূলকভাবে বেশি সময় স্থায়ী হয়।

এদিকে চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে solar terms)। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এই ২৪টি সৌরপদ বা সোলার টার্ম হচ্ছে: লি ছুন (বসন্তের শুরু), ইয়ুশুই (বৃষ্টির পানি), চিংচ্য (পোকামাকড়ের জাগরণ), ছুনফেন (বসন্ত বিষুব), ছিংমিং (তাজা সবুজ), কুইয়ু (শস্য-বৃষ্টি), লিসিয়া (গ্রীষ্মের শুরু), সিয়াওমান (কম পূর্ণতা), মাংচুং (ফসল বোনার সময়), সিয়াচি (উত্তরায়ন), সিয়াওশু (কম গরম), তাশু (বেশি গরম), লিছিয়ু (শরতের শুরু), ছুশু (গরমের শেষ), পাইলু (শুভ্র শিশির), ছিউফ্যন (শারদীয় বিষুব), হানলু (ঠান্ডা শিশির), শুয়াংচিয়াং (প্রথম হিমেল হাওয়া), লিতুং (শীতের শুরু), সিয়াওসুয়ে (ছোট তুষার), তাসুয়ে (বড় তুষার), তুংচি (দক্ষিণায়ন), সিয়াওহান (ছোট শীত), তাহান (বড় শীত)।

প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকান্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে- তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে।

এখন চলছে সৌরপদ লি সিয়া বা গ্রীষ্মের শুরু। এটি চীনের সপ্তম সৌরপদ। চীনা ভাষায় ‘লি’ মানে ‘শুরু’ এবং ‘সিয়া’ মানে ‘গ্রীষ্মকাল’। এবার লি সিয়ার ব্যাপ্তিকাল ৫ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত।

চীনে আনুষ্ঠানিকভাবে চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে গেছে। তবে শীত যাই যাই করেও ঠিক যাচ্ছে না। কখনও-সখনও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসছে। তখন দিনের বেলায় আমাদের গায়ে হালকা জ্যাকেট ওঠে, রাতে পাতলা কম্বল। গত দশ বছর ধরে দেখছি, প্রতি বছর এমনটিই ঘটে। এই মনে হয়, শীত চলে গেছে; কিন্তু দু’দিন বাদেই হালকা ঠান্ডা অনুভূত হয়। এভাবে কিছুদিন চলবে। তারপর পড়বে আসল গরম, শুরু হবে প্রকৃত গ্রীষ্মকাল; হালকা জ্যাকেট ও কম্বলগুলোও কয়েক মাসের জন্য তখন বেকার হবে।

যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২৩৯ বছর আগে প্রাচীন চীনের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলেছিল। সেই সময়টা ইতিহাসে ‘যুদ্ধরত রাষ্ট্রসমূহের যুগ’ (Warring States Period) নামে চিহ্নিত। তো ওই যুগে ‘লি সিয়া’ টার্মটির উৎপত্তি। এই সৌরপদটি বরাবরই গম ও ক্যানোলা চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল ও আছে। তাই প্রাচীন আমলের চীনা সম্রাটরাও এ সৌরপদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। চৌ রাজবংশ আমলের (১০৫০-২২১ বিসি) সম্রাট তো এই সৌরপদকে স্বাগত জানাতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন এবং নাগরিকদের এ সময় কৃষিকাজ শুরু করার পরামর্শ দিতেন। লি সিয়াকে স্বাগত জানাতে সম্রাট নিজে এবং রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্য ও রাজ-কর্মকর্তারা লাল রঙের নতুন পোশাক পরতেন। রাজপ্রাসাদের ঘোড়াগুলোকেও সাজানো হতো লাল রঙের পোশাক ও অলঙ্কারে। এসময় গোটা প্রাসাদও সাজতো রঙিন সাজে। এসবই করা হতো ‘গ্রীষ্মের দেবতা’কে তুষ্ট করতে; আশা করা হতো, এতে ফলন ভালো হবে।

লি সিয়া সৌরপদে ব্যক্তির ওজন মাপার একটা প্রথাও চীনে চলে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াইশ বছর পর, চীনের ‘তিন রাজ্য যুগ’-এ (Three Kingdoms Period) এ প্রথার উৎপত্তি। সেই প্রাচীন প্রথাটি দক্ষিণ চীনে এখনও টিকে আছে। এখনও অনেক চীনা বিশ্বাস করেন যে, লি সিয়া সৌরপদের প্রথম দিনে ওজন মাপলে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে ও এ কাজ ব্যক্তির জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। ওজন মাপার জন্য বেছে নেওয়া হয় দুপুরের খাবারের ঠিক পরের সময়টিকে। একে একে ঘরের ছোট-বড় সবার ওজন মাপা হয়। যিনি ওজন মাপেন, তিনি ওজন মাপার সময় মন্ত্র পড়েন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, লি সিয়া সৌরপদের প্রথম দিন ব্যক্তির ওজন মাপা না হলে, গ্রীষ্মকালে সেই ব্যক্তি নিশ্চিতভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়বে।

লি সিয়া সৌরপদে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ডিম খাওয়ার প্রথাও প্রচলিত সেই প্রাচীন কাল থেকে। প্রাচীন চীনে এ কথা বিশ্বাস করা হতো যে, গোলাকৃতির ডিম হচ্ছে সুখী জীবনের প্রতীক। এ বিশ্বাস থেকেই লোকেরা এই সৌরপদে ডিম খেতো এবং বিশেষ প্রার্থনার মাধ্যমে গ্রীষ্মকালে পা রাখতো। তবে এ ডিম খাওয়ার পদ্ধতি খানিকটা ভিন্ন। প্রাচীনকালে চা তৈরির পর যে চা-পাতা অবশিষ্ট থেকে যেত, তার সঙ্গে ডিম মিশিয়ে সেদ্ধ করা হতো। ব্যস, তৈরি হয়ে যেত ‘চা ডিম’। আর এই ‘চা ডিম’-ই লোকেরা খেতো। পরে ‘চা ডিম’ তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন মসলার ব্যবহার শুরু হয়। আধুনিক চীনে এই ‘চা ডিম’ ঐতিহ্যবাহী স্ন্যাক হিসেবে প্রচলিত।

প্রাচীন চীনে এটাও বিশ্বাস করা হতো যে, শিশুদের বুকের কাছে ডিম ঝুলিয়ে রাখলে গরমের অসুখ-বিসুখ থেকে তারা মুক্ত থাকবে। এ বিশ্বাস থেকেই বাবা-মায়েরা ডিম সিদ্ধ করতেন ও ছোট ব্যাগে পুরে তা ঝুলিয়ে দিতেন শিশু-সন্তানদের গলায়। আধুনিক চীনাদের অনেকেই এখন আর সিদ্ধ ডিমের এহেন মাহাত্ম্য স্বীকার করেন না, তবে অনেকেই প্রথাটি অনুসরণ করেন। তারা উল দিয়ে বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট থলে তৈরি করেন এবং সেগুলোতে সিদ্ধ ডিম পুরে ঝুলিয়ে দেন নিজ নিজ সন্তানের গলায়। এই ডিম দিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও চলে চীনের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। বাচ্চারা জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়ায় এবং ডিমে ডিমে ঠোকাঠুকির খেলা খেলে। যার ডিম অক্ষত থাকে, সে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়।

ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, লি সিয়া সৌরপদে মানুষের হার্টের বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরি। এ সময় আবহাওয়া ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর। তাই লি সিয়া সৌরপদে ভিটামিনসমৃদ্ধ ও ঠান্ডা জাতীয় খাবার বেশি বেশি খাওয়া উচিত। চীনারা এমনিতেই সবজি খেতে পছন্দ করেন। সপ্তম সৌরপদ শুরু হলে সবজির প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব বাড়ে। এতে শসা, টমেটো, তরমুজ, নাশপাতি, স্ট্রবেরির চাহিদা এ সময় আরও বেড়ে যায়।