Walton
ads
D Diamond

নাপা নয়, মিষ্টির সাথে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয় দুই শিশুকে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জালাল উদ্দিন

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০২২, রাত ৮:৪০

Brahmanbaria murder arrest pic.jpg

টানা ৭ মাসের পরকীয়া প্রেম, দফায় দফায় শারীরিক সম্পর্ক, ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ, ইচ্ছা সংসার বাঁধার। পরকীয়া প্রেমিক শিশুদের নিয়ে বিবাহ করতে রাজী নয়। পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় দুটি শিশু। তাহলে উপায় কি? যে কোন ভাবেই হউক তাদেরকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে। এমন খায়েশ থেকেই জলজ্যান্ত দুটি সন্তানকে মিষ্টির সাথে বিষ খাইয়ে গর্ভধারনি মা হত্যা করেছে। ঘটনাকে ভিন্ন দিকে মোড় ঘুরাতে সাজানো হয় নাপা সিরাপ সেবনে মৃত্যুর কথা। এ নিয়ে তোলপাড় হয়ে উঠে সারাদেশ। ঘটনার তদন্তে পৃথক ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। টনক নড়ে স্বাস্থ্য বিভাগেরও। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রী ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের। নড়ে চরে বসে স্থানীয় প্রশাসন।

গত ১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের দূর্গাপুর গ্রামে নাপা সিরাপ সেবনে কিছুক্ষন পরেই মৃত্যু কোলে ঢলে পড়ে দুই সহোদর শিশু ইয়াছিন খান (০৭) ও মোরসালিন খান (০৫)। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয় নাপা সিরাপের। সেখানে ক্ষতিকর উপাদান মেলেনি। এর মধ্যেই জেলা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পুলিশের সূত্র জানায়, এক সপ্তাহ ধরে নজরবন্দি রাখে শিশুর মাতাকে। প্রযুক্তিগত তদন্তসহ নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে চাঞ্চল্যকর এই ডাবল মার্ডার রহস্য ৭ দিনের মধ্যেই উদঘাটন করে পুলিশ।

বুধবার রাতে আশুগঞ্জ থানা পুলিশ শিশুদের মা লিমাকে গ্রেফতার করেছে। আদালতে জবানবন্দির পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, লিমা আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পুলিশের কাছে এর আদ্যপান্ত বর্ণনা দেয়। পরকীয়া প্রেমিক সফিউল্লাকেও গ্রেফতারে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযানে চালিয়ে যাচ্ছে। সুত্র জানায়, শিশুদের মা লিমা আক্তার মইসার গ্রামে শ্রমিক সর্দার সফিউল্লাহর সাথে দীর্ঘ দিন ধরে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। এরপর তারা বিবাহের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে শিশু দুটি তাদের নতুন সংসার করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাড়াঁয়। তাই পথের কাটা সরাতে এই নৃশংসতার পথ খুজে নেয় তারা। সুত্র মতে, পরকীয়া প্রেমিক তার বাড়িতে বিষ মেশানো ৫টি মিষ্টি পাঠায়। মিষ্টি গুলো খাবারের নির্দেশনা প্রদান করে। এর পর বড় শিশু ৩টি ও ছোট শিশুকে ২মিষ্টি খাওয়ানো হয়। এর পর তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর আগ থেকেই তাদের কিছুটা জ¦র ছিল। তাই পরিবারের মাতাকে বাহিরের দোকান থেকে নাপা সিরাপ আনতে বলে। পরে সিরাপও খাওয়ানো হয়।

যে ভাবে হত্যা করা হয় শিশু সন্তানদেরঃ

অনুসন্ধানে জানাযায়, ১২ বছর আগে লিমার বাবা-মা তার অমতে পাশের পাড়ার ইসমাইল হোসেন প্রঃ সুজনের সাথে বিয়ে দেয়। বিয়ের আগে সে ইসমাইল হোসেনকে কখনো দেখেনি। বিয়ের দিন সে জানতে পারে তার স্বামী চোখে দেখে না এবং স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারে না। বিয়ের প্রথমদিন থেকেই স্বামীকে তার পছন্দ ছিল না। বিয়ের ১৫ দিন পর স্বামী তাকে বাপের বাড়ী থেকে আনতে গেলে সে তার সাথে গিয়ে সংসার করতে রাজি ছিল না। এরপর তার স্বামী এবং তার চাচাতো ভাই জমিন ও তার মা সবাই জোরাজড়িু করে বোঝালে অনিচ্ছা থাক স্বত্ত্বেও স্বামীর বাড়িতে আসে এবং সংসার করতে থাকে। স্বামী স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারে না বলে বিয়ের এক বছর পর থেকেই সে ধানের মিলে কাজ শুরু করে। পরে নিজেই উপার্জন করে সংসার চালাতে থাকে। বিয়ের ২ বছর পরে তার প্রথম ছেলে সন্তান হয়। অসুখের কারণে জন্মের ২ দিন পরই হাসপাতালে সে মারা যায়। এই ঘটনায় সংসারের উপর থেকে তার মন উঠে যায়। বিয়ের প্রায় ৪ বছর পরে তার দ্বিতীয় সন্তান ইয়াছিন জন্মগ্রহণ করে। এরপর থেকে ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে অভাব অনটন বেড়ে যায়। স্বামীর সাথে তার অশান্তি বেড়ে যায়। সংসারে তার শাশুড়ী, ভাসুর এবং ভাসুরের বউ বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন ভাবে তার স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে তার দ্বারা লিমাকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অত্যাচার করত। এভাবেই সে রাইস মিলে কাজ করে সংসার চালাতো। ইয়াছিনের আড়াই বছর পরে তার তৃতীয় সন্তান মুরছালিন জন্মগ্রহণ করে। তখন সংসারের দায়িত্ব বেড়ে গেলে পারিবারিক অশান্তি আরো বেড়ে যায়। সে সময় লিমা দুই সন্তানকে বাসায় রেখে বাহাদুপুরে বাহাউদ্দিনের ধান মিলে কাজ শুরু করে। এই মিলে প্রায় ৭ বছর কাজ করে। ২০২০ সালে শুরুর দিকে বাহাদুরপুর লাল ফারুকের ধানের মিলে কাজ শুরু করে। সেখানে এক বছর কাজ করার পর প্রায় ১০ মাস পূর্বে বগইর এলাকায় এস. আলম রাইস মিলে কাজ শুরু করে। সুত্র জানায়, বিয়ের প্রথম দিন থেকেই তার স্বামী প্রতিবন্ধী ও যৌন দুবর্লতার কারণে তাকে পরিপূর্ণ সুখ দিকে পারত না। এস. আলম রাইস মিলে কাজ করতে গিয়ে দুই মাস পরে মিলের সর্দার সফিউল্লাহ ্ওরফে সোফাই এর সাথে পরিচয় হয়। কিস্তির দশ হাজার টাকা ধারের জন্য সোফাই সর্দার এর কাছে গেলে তার কু নজর তার উপর পড়ে। এই ভাবে চলতে চলতে ৩ মাস পরে তার সাথেই কাজ করা একজনকে দিয়ে সোফাই সর্দার বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সে সময় সে স্বামী এবং দুই সন্তানের কথা বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তার স্বামীর যৌন দুর্বলতা এবং সংসারের অভাব অনটনের কারণে সর্দার এর উপর লিমার আকর্ষণ কাজ করতে থাকে। স্বামী ইট ভাটার কাজে সিলেটে গেলে সোফাই সর্দারের সাথে তার অবাধ মেলামেশার সুযোগ তৈরি হয়। প্রায় ৩ মাস আগে এই ভাবেই চলতে চলতে দুই জনের মধ্যে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্ক চলকালীন সময়ে লিমা তার প্রেমকিকে নিয়ে বিশ্বরোড আবাসিক হোটেলের ৩য় তলার একটা রুমে শারীরিক সম্পর্ক করে। তাদের সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে ফেনে কথাপোকথন এবং ধানের মিলে দেখা সাক্ষাত চলছিল। এসময় সোফাই সর্দার তাকে ভালবেসে ১টি শ্যাম্পু, ১টি লোশন, ১টি ক্রিম, ২টা মাথার ব্যান্ড এবং ১ জোড়া জুতা উপহার দেয়। স্বামীর দেওয়া মোবাইল ও সিম ব্যবহার করে তারা কথা বলতো। গত এক মাস আগে সোফাই সর্দার তার সিমটি লিমাকে ব্যবহার করতে দেয়। অবৈধ সম্পর্ক চলকালীন বিভিন্ন সময় সফিউল্লাহ ওরফে সোফাই সর্দার দুই ছেলেকে ছেড়ে বিয়ে করার কথা বলত। সন্তানদের কথা বললে সে বলত পথের কাটা ২টা সরাও। ব্যবস্থা আমি করব। তোমার এই গুলি নিয়ে ভাবতে হবে না। ঘটনার ৩ দিন আগে ৭মার্চ সন্ধ্যায় দুইজন এস.আলম মিলে কাজের সময় বসে লিমার দুই সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে সময় সোফাই বলে আমি বিষ মেশানো মিষ্টি তোমার বাড়ীতে দিয়ে আসলে তুমি সুযোগ বুঝে ছেলেদের তা খাওয়াই দিবা। তারপর যা হবার হবে। ঘটনার দিন ১০মার্চ তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকবার কথা হয়। সে দিন আছর নামাজের পর লিমার শাশুড়ী এলাকায় ওয়াজ শুনতে বাড়ির বাহিরে গেলে সেই সুযোগে সোফাই সর্দার বাড়ির পিছনের দক্ষিন পাশের কোনায় এসে তার হাতে পলিথিনের ব্যাগে ৫টি মিষ্টি দিয়ে যায়। রাস্তায় গিয়ে লিমার শাশুড়ীকে পাওনা টাকা দেওয়ার জন্য ফোন করে ডাকে। শাশুড়ী টাকা নিয়ে বাড়িতে আসলে লিমার ছেলের গায়ে জ্বরের কথা বলে বুদ্ধি করে তাকে নাপা সিরাপ আনতে বাড়ির পাশের ফার্মেসীতে পাঠানো হয়। এরপর পরিকল্পনা মাফিক বিষ মিশানো মিষ্টি দুই সন্তানকে খাওয়ায়। মিষ্টি খাওয়ানোর ৫ মিনিটের মধ্যেই নাপা সিরাপ নিয়ে তার শাশুরী আসলে সাথে সাথে নাপা সিরাপ আধা চামচ করে দুই ছেলেকে খাওয়ানো হয়। সব কিছুই ছিল পরিকল্পনা মাফিক। যেনো কেউ বুঝতে না পারে। সবাই যেনো মনে করে ঔষধে কোন ঝামেলা ছিল যার কারণে আমার ছেলেরা মারা গিয়াছে। ঔষধ খাওয়ার ১০ মিনিট পরে তার দুই ছেলে একত্রে দুই বার বমি করে। তারপর তাদের মাথায় পানি ঢালা হয়। এরপর কাউছার মিয়ার সিএনজিতে দুই সন্তানকে নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে যায়। ডাক্তার এসে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মূল বিষয় আড়াল করে বলা হয় যে, নাপা সিরাপ খাওয়ার পরে তার ছেলেরা বমি করে অসুস্থ্য হয়ে গেছে। তাৎক্ষনিক ভাবে ডাক্তার বড় ছেলে ইয়াছিনকে ১৫ মিনিট এবং ছোলে মুরছালিনকে ১৫ মিনিট করে অক্সিজেন দেয়। আশুগঞ্জ হাসপাতালে আসলে সোফাই সর্দার সেখানে তাদের দেখতে আসে। এরপর ডাক্তার দ্রæত উন্নত চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে নিতে বললে সাদ্দাম এর সিএনজি করে তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে টিকিট কেটে ইমারজেন্সিতে দেখালে ডাক্তার আমার বর্ণনা মতে নাপা সিরাপ খেয়ে অসুস্থ্য হওয়ার কথা শুনে বলে যে এটা সামান্য বিষয় বাসায় গিয়ে বেশি বেশি লেবুর পানি খাওয়ান সব ঠিক হয়ে যাবে। পরে সেখান থেকে সিএনজি করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে বিশ্বরোড মোড়ে আসতেই ছোট ছেলে মুরছালিন পানি খায় এবং আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে যায় এবং মৃত্যু বরণ করে। এরপর খবর পেয়ে বাড়িতে পুলিশ এবং আশপাশের লোকজন জড়ো হলে বিষের কথা গোপন করে তাদেরকে জানানো হয় নাপা সিরাপ খাওয়ার পরে তারা অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। ঐদিন পুলিশ লিমার মোইল ফোনের নাম্বার নিয়ে গেলে লিমা ভয় পায়। ১২ মার্চ লিমার সাথে একই মিলে কাজ করা মালার মাধ্যমে মোবাইল ফোন এবং সিমটি সোফাই সর্দারের নিকট ফেরত পাঠায়। এরপর তার স্বামী মোবাইলটি দেখতে না পেয়ে এই বিষয় নিয়ে চেচামেচি শুরু করলে শাশুড়ী ও তার মধ্যে ঝগড়া হয়। এরপর তাদের বাড়িতে পুলিশ আসলে পুলিশের জেরার মুখে লিমা সব পরিকল্পনা ও অপরাধের কথা স্বীকার করলে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে থানায় ৪ জনকে আসামী করে মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ২ জন অজ্ঞাত রয়েছে।

শিশুদের পিতা ইসমাইল খান জানান, লিমাকে ছফিউল্লাহ সর্দারের দেয়া সিমকার্ড ঘিরে সন্দেহ থেকেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সে হত্যার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। আমি এর বিচার চাই। এদিকে

পুলিশ সুপার -মোঃ আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে হত্যা কথা জানান তিনি বলেন জানান, রহস্যে ঘেরা ঘটনাটি প্রযুক্তিগত সহায়তা ও স্থানীয় তদন্তের মাধ্যমে উন্মোচন করা হয়।