Walton
ads
D Diamond

জালিয়াতি করে শ্রীপুর পৌরসভায় চাকুরী সবুজের

একই ব্যক্তির দুই জাতীয়পরিচয় পত্র

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি

রবিবার, ৯ জানুয়ারি ২০২২, বিকাল ৭:১৪

Screenshot 2022-01-09 191355.png

বাস্তবে একই ব্যক্তি। ভিন্ন দুটি নামে দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীর মাধ্যমে ১০বছর বয়স কমিয়ে শ্রীপুর পৌরসভায় রোড রোলার পদে চাকুরী নিয়েছেন সবুজ মিয়া। এছাড়াও করোনাকালীন সময়ে সকলের অগোচরে ১০জনের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এই পৌরসভায়। একই পরিবার থেকে ৩জন সহ অধিকাংশ লোক নিয়োগ করা হয়েছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এখন আরও ২৫জনের নিয়োগের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম শ্রেণীর এই পৌরসভায় নানা অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে দিন দিন আলোচনা বাড়ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, করোনাকালীন সময়ে গত বছরের ১০আগষ্ট শ্রীপুর পৌরসভায় ১০জনের নিয়োগ সম্পন্ন হয়। এ নিয়োগে পৌরসভার এক সময়ের মাষ্টাররোলের কর্মচারী জহিরুল হক সবুজ মিয়া রোড রোলার পদে চাকুরী নেন। চাকুরী বিধি অনুযায়ী বয়স ৩০এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিধান থাকায় সে নিজের বয়স ১০বছর কমিয়ে সবুজ মিয়া নামে ভিন্ন আরো একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করেন। তার এনআইডি নং ১৯৯০৩৩২৮৬০২০০০১৫৬। জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্য অনুযায়ী তার বাবার নাম আব্দুল হামিদ, মায়ের নাম হালিমা খাতুন। জন্ম তারিখ ৫অক্টোবর ১৯৯০।

যদিও পূর্ব থেকেই তার জহিরুল হক নামে আরো একটি জাতীয় পরিচয় পত্র যার নং ৩৩২৮৬০২০০৯০১২ ছিল, সেখানে পিতা, মাতা ও ঠিকানা এক থাকলেও জন্ম তারিখ ছিল ১৬নভেম্বর ১৯৮০ সে হিসেবে তার বর্তমান বয়স প্রায় ৪২বছর। বহুদিন পূর্বেই সরকারী চাকুরীতে নিয়োগের যোগ্যতা হারিয়েছেন সে। নির্বাচন কমিশনের এনআইডি বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সে এমন জালিয়াতি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের এমন জালিয়াতি তদন্ত করছে জেলা নির্বাচন অফিস।

অনুসন্ধানে জানা যায় জহিরুল হক ও সবুজ মিয়া একই ব্যক্তি। বাস্তবে তার বয়স ৪০এর অধিক। তার বাড়ী ছিল ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার কান্দিপাড়া বাকশী গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুল হামিদ। সে বাবা ও মায়ের বড় সন্তান।

সেখানে কান্দিপাড়া আশকর আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জহিরুল হক নামে ১৯৯৫সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ন হন। সেখানে তার রোল নং ২০৩৮৩২ কেন্দ্র ৩৬২ রেজিঃ নং ১৩৯৬০৩/১৯৯৫। যদিও পৌরসভায় চাকুরী নেয়ার সময় নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন অষ্টম শ্রেণী পাশ। পৌরসভার সামান্য কর্মচারী থাকলেও সে নিজে ব্যবহার করেন প্রায় ২৮লাখটাকার দামী গাড়ী। ব্যবহৃত গাড়ী নং ঢাকা মেট্রো-গ ৩১-৩৫৪৩ যা জহিরুল হক নামেই তার ক্রয় করা। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু জমিও জহিরুল হক নামে কিনেছেন।

একই পরিবার থেকে পৌরসভায় চাকুরী হয়েছে ৪জনের ঃ করোনাকালীণ সময়ে কেউ অবগত না থাকলেও শ্রীপুর পৌরসভায় নিয়োগ নথি-১/২০২০-৪৫৩ স্মারক মূলে ১০জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে একই পরিবার থেকে বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। শ্রীপুর পৌরসভার নক্সাকার জসিম উদ্দিনের বোন জান্নাতুল ফেরদৌসিকে সহকারী কর আদায়কারী, তার স্ত্রী লিজা আক্তারকে সহকারী লাইসেন্স পরিদর্শক, তার স্ত্রীর ভাই(শালা) ফেরদৌস আহমেদকে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে এ নিয়োগে সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল জহিরুল হক ওরফে সবুজ মিয়ার। তার নিজের নিয়োগ ছাড়াও অধিকাংশ প্রার্থী তারই লোক। পৌরসভার মেয়র সহ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এ নিয়োগ বাগিয়ে নেয়া হয়। এখানে কয়েককোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্য হয়েছে। চাকুরীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রচারের বিধি থাকলেও ফেনীর একটি আ লিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে রাতের আধারে এ নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। কাগজ কলমে নিয়োগ সম্পন্ন হলেও বাস্তবে কোন কিছুই মানা হয়নি। পৌরসভায় এসব কর্মকর্তা কর্মচারী যোগদান করতে এলে নিয়োগের বিষয়টি সবার সামনে উঠে আসে।

নিয়োগ কমিটির সদস্য সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিলান উদ্দিন দুলাল বলেন, নিয়োগ পরীক্ষা কোথায় বা কিভাবে হয়েছে তা আমরা অবগত নই। আমাদের স্বাক্ষর দিতে বলেছিল আমরা স্বাক্ষর দিয়েছি।তবে কিভাবে কি হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।

ছোট ভাই যেখানে বড় ঃ এ নিয়োগের পূর্বে শ্রীপুর পৌরসভায় চাকুরী হয়েছে জহিরুল হক সবুজ মিয়ার ছোট ভাই সাইদুর রহমান জজ মিয়ার।সে পৌরসভার অফিস সহায়ক পদে কর্মরত। তার জাতীয়পরিচয় পত্রের তথ্য গোপন করে শ্রীপুর পৌরসভা থেকে জন্ম নিবন্ধন নিয়ে চাকুরী নিয়েছেন। তার জন্ম তারিখ ০৩মার্চ ১৯৮৮। এখানে ছোট ভাই বড় ভাইয়ের চেয়ে ২বছরের বড়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রীপুর পৌরসভার বেশ কয়েক জন কর্মকর্তা কর্মচারী জানান, ২০০২ সালে জহিরুল হক সবুজ মিয়া পৌরসভার মাষ্টাররোলের কর্মচারী হিসেবে পৌরসভায় যোগ দেন। সকল কাগজপত্রে তার নাম জহিরুল হক উল্লেখ করলেও তার ডাক নাম ছিল সবুজ মিয়া। প্রকৌশল বিভাগে কাজ করার সূত্র ধরে সে ঠিকাদারী ব্যবসার মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। এ সিন্ডিকেটেই মূলত শ্রীপুর পৌরসভার বিভিন্ন ভাবে কাজের নিয়ন্ত্রনে ছিল। ধীরে ধীরে মেয়রের আস্থভাজন হিসেবে নিজেকে তৈরী করে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রন নিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা নিজের পকেটে নিয়ে আসেন। পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বদলী,মন্ত্রনালয়ে যোগাযোগ রক্ষা সহ সব কাজই বর্তমানে এই ব্যক্তির হাতেই।

এবার ২৫জনের নিয়োগের জন্য দৌড়াদৌড়ি ঃ শ্রীপুর পৌরসভায় ১০জনের নিয়োগের পরই আরো ২৫টি পদে নিয়োগের ছাড়পত্রের জন্য গত ৩০জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর স্মারক নং শ্রীপস/প্রশাঃ/২০২০-২০২১/২১০ মূলে আবেদন করেন পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান। পরে মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর চাহিদা পদে ছাড়পত্রের জন্য মাননীয় মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী গত ১০জুলাই চাহিদাপত্র প্রেরণ করলে চুড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এ নিয়োগের ছাড়পত্র। আশংকা করা হচ্ছে অধিকাংশ পদেই ফের কয়েককোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্যের পায়তারা চলছে।

নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব পৌরসভার সচিব দলিল উদ্দিন বলেন, এ নিয়োগে আইন বহির্ভুত তেমন কিছু করা হয়নি। নিয়োগের জন্য কতজন আবেদন করেছিল নিয়োগ পরীক্ষা কোথায় হয়েছিল এবিষয়েও তিনি কথা বলবেন না বলে জানান। তবে সবুজ মিয়ার বয়সের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করছে আমরা তাদের সহায়তা করছি।

গাজীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কাজী ইস্তাফিজুল হক আকন্দ বলেন, এমন একটি অভিযোগ তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এর তদন্ত চলছে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। সেখানেই তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

অভিযুক্ত জহিরুল হক ওরফে সবুজ মিয়ার ভাষ্য, তিনি সব কাগজপত্র নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন থেকে ঠিক করেছেন। এখন তার পূর্বের জাতীয় পরিচয়পত্র আর সার্ভারে পাওয়া যাবে না। তাই পরেরটাই বৈধ। বয়স কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, একটি চাকুরী নিতে নানাভাবে চেষ্টা করে মানুষ। তিনি তাই করেছেন।

এ বিষয়ে শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান বলেন, সম্পূর্ন নিয়ম মেনেই কাগজপত্র ঠিক পাওয়ায় তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে সে যদি জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কোন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে তাহলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।